অম্বুবাচী পার্বণ, রাজবংশী সমাজের আমাতি হিসাবে পালিত

বাপ্পা রায়, ময়নাগুড়ি, ২৩ জুন : বরাবর বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে রাজবংশী সমাজ। সে ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির পার্থক্য যেমন থাকে তেমনি পার্থক্য থাকে নামেও। শুরু হয়েছে অম্বুবাচী পার্বণ, যা রাজবংশী সমাজে আমাতি নামে পরিচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই অম্বুবাচী উৎসব বিভিন্ন ঋতুতে পালিত হলেও রাজবংশী সমাজ ভিন্ন রীতিতে এই পার্বণ পালন করে থাকেন।

অম্বুবাচী পার্বণ মূলত কামাখ্যা দেবীর ঋতুকাল সমাগত হয় বলে এই উৎসব পালন করা হয়।হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র অনুযায়ী,৭ থেকে ১০ আষাঢ় পর্যন্ত অম্বুবাচী পালন করা হয় । সনাতনী মতে, আষাঢ় মাসের মৃগশিরা নক্ষত্রের তৃতীয় চরণ শেষ হলে মা বসুন্ধরা ঋতুমতী হন। তখনই উৎযাপিত হয় অম্বুবাচী। এইসময় চাষাবাস নিষিদ্ধ। ঘটা করে অম্বুবাচী পালিত হয় কামরূপ কামাক্ষ্যায়। ঋতুমতী হন স্বয়ং দেবী। বন্ধ থাকে মন্দিরের দরজা। 

সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন , আষাঢ়ের ৭ তারিখ থেকে ১০ তারিখে উৎযাপন করা হয় অম্বুবাচী। কথিত আছে,আষাঢ় মাসে সূর্য মিথুন রাশিতে প্রবেশের সময় ঋতুমতী হয়ে ওঠেন ভূদেবী।বর্ষার আগে অম্বুবাচীতে ঋতুমতী হন তিনি। আদি শক্তি মহামায়ার আর এক রূপ দেবী কামাক্ষ্যা রজঃস্বলা হন অম্বুবাচীতে। যোনিপীঠের উপর বিছিয়ে দেওয়া থাকে সাদা কাপড় ,ওই সময় সাদা কাপড় লাল হয়ে ওঠে। চার দিন ধরে চলে অম্বুবাচীর মেলা। এই অম্বুবাচীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন নিয়মনীতিতে পালন করে থাকেন। রাজবংশী সমাজের মানুষ অন্যদের থেকে ভিন্ন রীতিতে আমাতী পালন করেন। রাজবংশী সমাজে এই সময় দেবতার মন্দির দরজা বন্ধ থাকে,পূজা অর্চনা, হালচাষ বন্ধ থাকে, এমন কি মাটির ভিতরে এমন সবজি তোলাও বন্ধ থাকে। বিভিন্ন ধরনের পাতা শাক এই সময় খায়না রাজবংশীর মানুষেরা। যদিও এই সময় ছোট ছোট কচিকাঁচারা ঘর করে সেখানে পুজো দিয়ে পথচলতি মানুষদের কাছ থেকে নটকা খেজুর সংগ্রহ করেন। যদিও এই বিষয়টি মূল আমাতি এর অংশ নয়। গবেষকরা জানিয়েছেন ছোট শিশুদের এই উৎসব একটা লোকাচার বা এই পৃথিবীটাকে স্মরণে রাখবার একটা প্রচেষ্টা মাত্র।

   এই বিষয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক রতন চন্দ্র রায় বলেন," অম্বুবাচীকে রাজবংশীরা আমাতি বলে থাকেন। এই সময় রাজবংশীরা পূজা অর্চনা যেমন বন্ধ রাখেন তেমনি খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে ও কিছু নিয়ম দেখা যায়। যেমন শাক পাতা এই সময় খায়না।আবার কিছু কিছু রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকায় কাঁচা গরুর দুধ খাওয়ার রীতি দেখা যায়। অম্বুবাচীর শেষে রাজবংশীরা বাড়িতে ঠাকুর পূজা অর্চনা করে এবং প্রসাদ হিসেবে দুধ দই, কাঁঠাল, আম , নোটকা , দিয়ে থাকে। এছাড়াও অম্বুবাচী র শেষে রাজবংশী অধ্যুষিত গ্রামের দিকে একটি নিয়ম দেখা যায়, বাচ্চারা ছোট রাস্তার পাশে কলার গাছ গেড়ে ধূপ ধূনা দিয়ে পূজা দিয়ে বসে থাকে বাজার করে লোকেরা যখন বাড়ি আসে তখন সবাই কিছু কিছু ফলমূল দিয়ে যায়। যদিও এই রীতি একটা লোকাচার মাত্র।"

এই অম্বুবাচী ও মা কামাক্ষ্যা পূজা উপলক্ষে মেলা শুরু হল ময়নাগুড়ি ব্লকের পদমতি ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত এর মনির বাড়ি এলাকায়। জানা যায়,প্রায় ৬০-৭০ বছর আগে মনির বাড়ির দুইজন ব্যক্তি আসামের কামাক্ষ্যা মন্দিরে পূজো দিয়ে  ফিরে এসে মনির বাড়ি গ্রামে মা কামাক্ষ্যার পূজার সুচনা করেন । এরপর ১৯৮২ সালে বিবাদি সংঘ নামে একটা ক্লাব এই পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন থেকেই নিয়ম মেনে প্রতি বছর পূজা ও মেলার  আয়োজন হয়। এবারও বূধবার থেকে রবিবার পর্যন্ত মেলা চলবে বলে পূজা কমিটি জানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *