কফিন বন্দি হয়ে ঘরে ফিরলেন জগন্নাথ, পুত্রশোকে আকুল মা, গান স্যালুটে বিদায়
ক্ষীরোদা রায় ও সুব্রত রায়, ধূপগুড়ি: ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল, তবে কফিন বন্দি হয়ে। গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া। বীর সন্তানের কফিন বন্দি দেহ ঘরে ফেরার অপেক্ষাতে ছিলেন সবাই। যুবকেরা মোটর বাইকে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রেলি করে নিয়ে আসেন শহিদ জওয়ানের কনভয়। ২৫শে মার্চ কাশ্মীরের লাওয়াপোরোতে লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুরুতর জখম হন ধূপগুড়ির পশ্চিম শালবাড়ি গ্রামের জগন্নাথ রায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় ৯২ বেস বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে চলে জীবন যুদ্ধ। সোমবার সন্ধ্যায় শহীদ হন জগন্নাথ রায়। সিআরপিএফের ৭৩ নং ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবল জগন্নাথ রায়। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, তিন বছরের পুত্র, দাদা, বৌদি ও ভাইঝি। বুধবার তাঁর কফিন বন্দি নিথর দেহ নিয়ে আসা হয় ধূপগুড়ির পশ্চিম শালবাড়ি গ্রামের বাড়িতে।
মঙ্গলবার কাশ্মীর থেকে নয়া দিল্লীতে আনা হয় এই সিআরপিএফ জওয়ানের মৃতদেহ। সেখানে সেনা আধিকারিকরা শেষ শ্রদ্ধা জানান। বুধবার দিল্লি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে আনা হয় জওয়ানের মরদেহ। বিমানে সঙ্গে ছিলেন দাদা পরেশ রায়। বাগডোগরাতে নেমে শিলিগুড়ি থেকে সেনাবাহিনীর কনভয়ে করে ধূপগুড়ির পশ্চিম শালবাড়িতে আনা হয়। উল্লেখ্য, গত শনিবার শহীদ সিআরপিএফ জওয়ানের দাদা পরেশ রায়, শ্যালক তাপস রায় ও জামাইবাবু গোপাল রায় শ্রীনগরের হাসপাতাল গিয়েছিলেন। তাপস রায় ও গোপাল রায় পৃথক বিমানে দিল্লী থেকে বাগডোগরা ফিরেছেন মঙ্গলবার।
গ্রামের বীর পুত্রের কফিন বন্দি নিথর দেহ নিয়ে সেনা আধিকারিকরা গ্রামে ঢুকতেই গ্রামবাসীদের চোখের বাঁধ ভেঙে যায়। আট বছরের পুত্রকে নিয়ে ডুকরে ওঠেন স্ত্রী তাপসি। বৃদ্ধা মা প্রমিলা রায় সন্তান শোকে আকুল হয়ে গিয়েছেন। উল্লেখ্য, ঘটনা জানার পর থেকেই পরিবারের সদস্যরা ভূলেই গিয়েছেন খাওয়া দাওয়া করতে। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন স্ত্রী। এদিন শহীদ জগন্নাথ রায়ের মৃতদেহ নিয়ে আসতেই জগন্নাথ রায় “অমর রহে” শ্লোগান দেয় জনতা, দেওয়া হয় “পাকিস্তান মুর্দাবাদ” ধ্বনি। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আর ক’দিন পরেই ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতেন তিনি, তারপর অন্য জায়গায় তাঁর পোস্টিং হতো।
সেনাবাহিনীর রীতি মেনে ড্রাম, বিউগল বাজিয়ে কনভয় করে জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া কফিনে করে শহীদের মৃতদেহ আনা হয় আধা সামরিক বাহিনীর কর্মীদের কাঁধে করে। বাড়ির সামনে মৃতদেহ রাখা হয়। তারপর গ্যালান্ডি নদীর পারের মাঠে মঞ্চ তৈরি করে ফুল মালা, রাজবংশী সমাজের হলুদ গামছা পরিয়ে এবং গান স্যালুট জানিয়ে শহীদ জওয়ানকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। দূর প্রান্তের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকের সমাগম ঘটে তাদের বীর সন্তানকে দেখার জন্য। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জগন্নাথকে।
এদিন জগন্নাথকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ ডাঃ জয়ন্ত রায়, ধূপগুড়ির প্রাক্তন বিধায়ক তথা তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মিতালি রায়, বিজেপির বিষ্ণুপদ রায়, ধূপগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীনেশ মজুমদার, ধূপগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান ভারতী বর্মন, ভাইস চেয়ারম্যান রাজেশ সিং, সিআরপিএফের ডিআইজি প্রভাঞ্জন। জাতীয় পতাকা লাগিয়ে যেভাবে যুবকেরা রেলি করে নিয়ে আসল তার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ডিআইজি বলেন, “জাতীয় পতাকায় শায়িত হয়ে কেউ ঘরে ফিরছে এটা সম্মানের, এ সম্মান সবাই পায়না।”
সাংসদ জয়ন্ত রায় শহিদ জওয়ানের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। শহিদের মা ও স্ত্রীকে সহানুভূতি জানান তিনি। তিনি বলেন, “সরকারি নিয়ম ও রীতি মেনে তাদের যে সমস্ত পাওনা আছে তা যেন তারা পান তার জন্য শহীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিআরপিএফের উপর মহলে যোগাযোগ করব।”
উল্লেখ্য সেন্ট্রাল কাশ্মীরের শ্রীনগর-বারমুল্লা জাতীয় সড়কের উপর লাওয়াপোরোতে সিআরপিএফ এর ৭৩ নং ব্যাটেলিয়ন এর কনভয়ের ওপর গত ২৫ শে মার্চ লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গি গোষ্ঠী হামলা চালায়। জঙ্গি হামলায় শহীদ হয়েছেন ত্রিপুরা ও হিমাচল প্রদেশের ২ জওয়ান এবং গুরুতর আহত হন ৩ জন। জখম তিন জনের মধ্যে ধূপগুড়ি ব্লকের পশ্চিম শালবাড়ি গ্রামের জগন্নাথ রায় ছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৯৩ বেস বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। চিকিৎসায় সাড়া না দিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় জগন্নাথ শহীদ হন।