করোনা আতঙ্কের আবহে প্রধান শিক্ষকের মানবিকতা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কোচবিহার : করোনা ভাইরাসের নিষ্ঠুর আক্রমণে সারা দেশে যখন লকডাউন চলছে তখন সেবাব্রতে কোনো জাত থাকে না। সেখানে হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান সবাই এক। সৎ পথে অর্থ উপার্জন করে সাধ্যমত আর্তের সেবা করে যেতে পারলে কার না ভালো লাগে। আজকাল বেশিরভাগ মানুষের ইন্দ্রিয় কামনা, বাসনা, লোভের আগুনে জ্বলছে। সামাজিক জীব হওয়া সত্বেও ক’জন মানুষ সমাজকে নিয়ে ভাবার অবকাশ রাখে ? প্রায়শঃ পদদলিত হচ্ছে মানবতা। এহেন সামাজিক অবক্ষয়ের সময়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বদা আর্তের সেবা করে যাচ্ছেন সাধারণভাবে জীবনযাপন করা শিক্ষক প্রবীর মিত্র। তিনি কোচবিহার-২ ব্লকের পাতলাখাওয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মানবতার সেবা তার ধর্ম। চাকুরিজীবনের শুরু থেকেই তিনি গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে আসছেন। কোনো ছাত্র বা ছাত্রী অভুক্ত রয়েছে কিনা, কোন্ শিক্ষার্থী অর্থাভাবে বই কিনতে পারছে না, কোন্ শিক্ষার্থীর বাবা-মা টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছে না। এরকম শুনতে পেলেই সেসব শিক্ষার্থী এবং তাঁদের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বারবার দেখা গেছে তাঁকে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের নিষ্ঠুর আক্রমণে সমস্ত দেশে হাহাকার। লকডাউন চলার ফলে মানুষ বাইরে বেরোতে পারছেন না। এসময় দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের অবস্থা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়। অভুক্ত থাকছে বহু মানুষ। পাশাপাশি ছোট্ট শিশুদেরও কষ্ট অসহনীয়। এরকম কারো অভুক্ত থাকার কথা কানে গেলেই সেখানে ছুটে যাচ্ছেন প্রবীরবাবু। লকডাউনে অত্যাবশ্যকীয় পন্যর দোকান খোলা রয়েছে। তাই তিনি কোনো একটি এলাকার একজন সৎ এবং বিশ্বাসযোগ্য বাসিন্দার কাছে শুনে নিচ্ছেন কোন্ কোন্ পরিবারের মানুষেরা অভুক্ত রয়েছেন এবং শিশুরা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। তা জানার পরেই প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী এবং বেবি ফুডের প্যাকেট নিয়ে লকডাউনের নিয়ম মেনে সোজা পৌঁছে যাচ্ছেন ওইসব বাড়িতে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজ হাতে বন্টন করছেন খাদ্য সামগ্রী। লক ডাউনের মাঝেই তিনি পৌঁছে গেছেন এরকম বহু পরিবারের কাছে। খাদ্য সামগ্রী বিলি করতে গিয়ে কিছু কিছু বয়স্ক মানুষের শীর্ণকায় চেহারা দেখে তিনি লুকিয়ে কেঁদেছেন। কিন্তু তাঁর চোখের জল দূর হয়ে যাচ্ছে তখন, যখন এইসব গুরুজনেরা তাঁর মহৎ কাজের জন্য তাঁকে আশীর্বাদ করছেন। প্রবীরবাবুর এই সহযোগিতার হাত পৌঁছে যাচ্ছে পৌর ও গ্রামীণ এলাকাসহ সর্বত্র। উত্তরবঙ্গ সংবাদের ঘরবন্দি বিভাগে যেদিন তার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সেদিন সেখানে তিনি বলেছিলেন এই লকডাউনের সময় তার অদম্য ইচ্ছে একেবারে গরীব মানুষ এবং স্কুলের দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের কাছে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যাওয়ার। সত্যিই তিনি তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। প্রশাসনের নিয়ম মেনে নিজের বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পাতলাখাওয়া গ্রামে যেখানে তাঁর বিদ্যালয়, সেই এলাকার দুঃস্থ ও হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খাবার নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি। প্রধান শিক্ষককে দেখে স্নেহের পড়ুয়াদের যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না যে স্যার তাদের বাড়ির দরজায় খাবার নিয়ে পৌঁছে গেছেন। পড়ুয়াদের অভিভাবকের হাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন নিজের হাতে। আর ছাত্র-ছাত্রীদের বলে আসছেন খাবার, লেখাপড়া, চিকিৎসার কোনোরকম অসুবিধা হলেই তাঁকে জানাতে।
পাতলাখাওয়া গ্রামে হিন্দু ও মুসলিম ছাড়াও বেশকিছু আদিবাসী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীর মানুষ বাস করে। লকডাউনের এই দুর্দিনে এই শিক্ষককে সমস্ত ধর্মের মানুষের বাড়িতে সাহায্য পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। কেননা তিনি বিদ্যালয়ে বেশিরভাগ সময়েই ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি বোঝান। করোনা ভাইরাস যে একজন শিক্ষকের হৃদয়ের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করলো তা বললেও বুঝি ভুল হবে না। ইতিমধ্যেই অনেক দুঃস্থ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছেন তিনি। যার খবর উত্তরবঙ্গ সংবাদে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। সেজন্য উত্তরবঙ্গ সংবাদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। উচ্চশিক্ষায় এবং পরিবারের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা পাওয়া ছাত্র সঞ্জীব বর্মন, সুস্মিতা সরকার জানায় প্রধান শিক্ষক আমাদের কাছে ভগবান স্বরূপ। তিনি যেন স্নেহ-ভালবাসার খনি। তিনি সবসময় মানবজাতিকে ভালোবাসার কথা বলেন। সত্যিই এসময় অনেকের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন সেবাব্রতের কোনো বিভেদ হয় না।
এ প্রসঙ্গে প্রবীরবাবু জানিয়েছেন চরম আর্থিক অনটনের সাথে লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি একসময়। তখন ভেবেছি ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হলে দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের আজীবন সহায়তা করে যাব। জীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ১৯৯৯ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মুর্শিদাবাদের একটি হাই স্কুলে সহ শিক্ষক পদে প্রথম যোগদান করি। চাকুরী পেয়েই ছাত্র সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করব বলে ঠিক করি। ঠিক তখনই আমার জীবনে নেমে আসে একটি অন্ধকারময় অধ্যায়। ২০০১ সালে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বাবা মা দুজনেই মারা যান। মৃত্যুশয্যায় দুজনেই আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন ভবিষ্যতে গরীব মেধাবী শিক্ষার্থী ও অন্যান্য দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাই পিতা মাতার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তখন থেকেই এই সেবার কাজ শুরু করি। এরপর ২০১৪ সালে কোচবিহার-২ ব্লকের পাতলাখাওয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। বিদ্যালয়ের গরিব, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি নিজের সাধ্যমত প্রতিনিয়ত আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করি। মানুষের সেবা পরম ধর্ম। যতদিন লকডাউন চলবে এভাবে সেবা করে যাবো সাধ্যমত। এভাবেই আজীবন গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে আলোর পথ দেখিয়ে যাবো। অর্থাভাবে ওদের শিক্ষাজীবন যেন কখনোই স্তব্ধ না হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *