কোচবিহার রাজ্য ও মরাঘাট পরগণার গাদংয়ের ইতিহাস

ব্রিটিশরা কোচবিহারে আসার পূর্বে সমগ্র উত্তরবঙ্গ, বিহারের কিয়দংশ, বর্তমান বাংলাদেশের রঙপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী বা আসাম থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কোচবিহার রাজ্য। সপ্তদশ শতকে ভূটান রাজ কোচবিহার আক্রমণ করেন, ডুয়ার্সের ব্যাপক অংশ দখল করেন। ভূটানের সঙ্গে কোচবিহারের সীমান্ত সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাতের ফলস্রুতিতে তৈরি হয়েছে বাইশচালা ছিট। বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং এলাকায় থাকা সেই বাইশচালা ছিটের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরলেন হামার চ্যানেলের নিউজ এডিটর ক্ষীরোদা রায়।

বর্তমান বাইশচালাঃ ধূপগুড়ি ব্লকের গাদং, গোঁসাইরহাট ও মাগুরমারি আদতে এই তিনটি এলাকা ছিল তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের মরাঘাট পরগণার বাইশচালা ছিট। বৃটিশরা ভূটান রাজার কাছ থেকে ডুয়ার্সের ওপর ভোগ দখলের অধিকার পেলেও, তিন হাজার পয়ষট্টি বিঘা জমি নিয়ে বাইশচালা ছিট তখনও কোচবিহারের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীনে সাবেক জলপাইগুড়ি জেলা আত্মপ্রকাশ করলেও ডুয়ার্সের কোলে থাকা এই এলাকাটি কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি ছিট রুপেই বিদ্যমান ছিল। তবে কোচবিহার রাজ্যের অবলুপ্তির সাথে বাইশচালা ছিট জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পর বিলুপ্ত হয় বাইশচালা ছিট। সাবেক বাইশচালা ছিটে এখন বাইশচালা নামে দুটি পাড়া রয়েছে বর্তমানে ধূপগুড়ি ব্লকের গিলান্ডি নদীর পারের গাদং ২ নং অঞ্চলের পশ্চিম শালবাড়ি ও মাগুরমারি ১ অঞ্চলের পূর্ব মাগুরমারি গ্রামে।

কোচবিহারের ইতিহাস ও বৃটিশ শাসনঃ ভারতে ব্রিটিশরা পদার্পণ করলেও কোচবিহার ছিল তাদের অধরা। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় একশ বছর ধরে ভূটানি আক্রমণে জেরবার কোচবিহার রাজ্যের উত্তরাংশ। রাজ্যের পশ্চিম ডুয়ার্স সহ সমতলের বহু এলাকা ভূটিয়াদের দখলে চলে যায়। ভূটিয়ারা লুঠপাট চালায়। সম্পূর্ণ ডুয়ার্স ভূটিয়াদের দখলে চলে যায়। এই সময় ব্রিটিশরা ভূটিয়াদের তোষণ নীতি গ্রহণ করেন।

মহারাজ উপেন্দ্র নারায়ণ (১৭১৪-১৭৬৩) সিংহাসনে আরোহন করেন তাঁর পিতা রূপনারায়ণ এর মৃত্যুর পর। উপেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে ভূটান রাজা কোচবিহার রাজ্যের উত্তরাংশ দখল করতে থাকেন। কয়েকবার যুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। ভূটানের আগ্রাসন রুখতে পারেননি মহারাজা। তাঁর মৃত্যুর পর ১৭৬৩ সালে মহারাজার শিশুপুত্র দেবেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনে আরোহন করেন। এই সময় ভূটান সেনাবাহিনী কোচবিহার রাজ্যভুক্ত এলাকাগুলি বিশেষ করে ‘চালা’ গুলি দখল করতে থাকেন। আততায়ীর হাতে দেবেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়। তাঁর উত্তরাধীকারী কেউ না থাকায় দেওয়ান দেও খড়্গ নারায়ণের পুত্র ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণকে রাজা ঘোষণা করা হয়।

১৭৬৫ সালে ভূটান সেনা জালাশ, মান্ডাস, লক্ষীপুর, সান্তারাবাড়ি, ভলকা ও‌ মরাঘাট পরগণা দখল করে। মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ (১৭৬৫-১৭৭০) ভূটানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল নেন। কিন্তু ভূটান রাজ বক্সায় ভোজসভার আমন্ত্রণ জানিয়ে কোচবিহারের রাজাকে তাঁর ভাই সুরেন্দ্র নারায়ণ, দেওয়ান দেও সহ অন্যান্য আধিকারিকদের বন্দি করে। বন্দি করে রাখা হয় ভূটানের তৎকালীন রাজধানি পুনাখার কারাগারে। কৌশলে ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণকে বন্দি করার পর ভূটানরাজ প্রতিনিধি পেন্-সুৎমা মহারাজার ভাই রাজেন্দ্র নারায়ণকে সিংহাসনে বসান। তাঁর হাতে তেমন ক্ষমতা ছিল না, ভূটানরাজ প্রতিনিধি সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করেন।

মহারাজ রাজেন্দ্র নারায়ণ (১৭৭০-১৭৭২)-এর মৃত্যুর পর ভূটিয়াদের হাতে বন্দি মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের পুত্র মহারাজ ধরেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। তিনি পেন্-সুৎমাকে কোচবিহার থেকে বহিস্কৃত করেন। বক্সাদুয়ার দিয়ে পালিয়ে গিয়ে পেন্-সুৎমা ভূটান রাজকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানান। ক্রুব্ধ ভূটান রাজ কোচবিহার আক্রমণ করেন। কোচসৈন্য পরাজিত হলে রাজমাতা নরেন্দ্র নারায়ণকে নিয়ে পালিয়ে যান এবং বৃটিশদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে কোচবিহার বৃটিশদের করদরাজ্যে পরিণত হয়। কোচবিহার ও ভূটানের মধ্যে ১৭৭২ সালে প্রথম যুদ্ধ হয় এবং ১৮৬৫ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধ ‌হয়। ধীরে ধীরে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লোপ পেয়ে বৃটিশদের অধীনস্থ করদ রাজ্যে পরিণত হয় কোচবিহার।

বাইশচালা ছিট ও কোচবিহার রাজ্যঃ তৎকালীন মোরাঘাট পরগণায় ভূটান ও কোচবিহারের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ ছিল। ওই সময়ে কোচবিহার রাজ্যের কমিশনার মিঃ স্কট মরাঘাট পরগণাকে ভূটানের হাতে সমর্পণ করতে রাজি ছিলেন না। এই এলাকায় কোচবিহার রাজার নির্মাণ করা কাছারিবাড়ি, পুকুর, রাজপথ ছিল। ১৮১১ সালের নভেম্বর মাসে প্রস্তাব ওঠে যে, গিলান্ডি নদীকে কোচবিহার ও ভূটানের সীমান্ত হিসেবে মেনে নেওয়ার। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মিঃ ডিগবির দেওয়া এই প্রস্তাব মেনে নেয় ভূটান রাজ, তদনুসারে কোচবিহার ও ভূটানের সীমান্ত সমস্যা সমাধান হয়। মরাঘাটকে বিভাজিত করা হয় এবং গিলান্ডি নদীকে দুই দিকের সীমানা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। ১৮১৯ সালে চামুর্চি জেলা ভূটানের অধীনে চলে যায়।

দ্য কুচবিহার স্টেট অ্যান্ড ইটস্ ল্যান্ড রেভেনিউ সেটলমেন্ট (১৯০৩) গ্রন্থে হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী বা খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমেদের কোচবিহারের ইতিহাস (১৯৩৬) গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় গিলান্ডি ও ডুডুয়া নদীর মাঝখানে থাকা মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং তালুকের বাইশটি চালাকে নিয়ে তিন হাজার পয়ষট্টি বিঘা জমির ওপরে এই বাইশচালা এলাকাটি কোচবিহার রাজ্যের দখলে ছিল। এই এলাকাটিকে বাইশচালা ছিট বলা হয়। উল্লেখ্য মোরাঘাট পরগণায় ২৮টি তালুক ছিল, ২২টি তালুক কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও গিলান্ডি নদীর উত্তর দিকে মরাঘাট পরগণার গের্দ্দ মরাঘাটের ৬টি তালুক ভূটিয়াদের দখলে চলে যায়। বাইশচালা ছিটের দক্ষিণে ছিল মাথাভাঙ্গা পরগণা।

কোচবিহারের ছিট বাইশচালা তিনটি তালুকে বিভক্ত। মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং। পরবর্তীকালে এই তিনটি এলাকায় জমি জরিপ করতে আসেন স্যান্ডার‌ সাহেব।

১৮৫০ সালে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ আয়োজন করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন ম্যাথিউ নামে এক আধিকারিক ও ডেপুটি কালেক্টর বেলফোর্ড‌ সীমান্ত জরিপ করেন ১৮৫১ সালে। কোচবিহারের সীমানার ভেতর মরাঘাটের বাইশচালাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। মেজর জেনকিন্স প্রস্তাব দেন তিনটি তালুকে থাকা বাইশটি চালাকে নিয়ে একটি প্লট তৈরি করার।

ক্রমশঃ চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *