কোচবিহার রাজ আমলে ছিলেন দেবশর্মা, ধূপগুড়ির বামনে বাসার ব্রাহ্মণরা হলেন চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য
ক্ষীরোদা রায়, ধূপগুড়িঃ গাদংয়ের দেবশর্মা পদবীর কামরুপী ব্রাহ্মণরা বাঙালি ব্রাহ্মণদের স্রোতে মিশে হয়েছেন চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য। তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের নলবাড়ি থেকে আসা দেবশর্মা পদবীর কামরুপী ব্রাহ্মনদের কোচবিহারের মহারাজা এনে বসিয়েছেন বর্তমান ধূপগুড়ির গাদংয়ের মত এলাকায়। বসতবাড়ি নির্মাণ এমনকি চাষাবাদের জন্য রাজা জমিও দিয়েছেন। রাজ আমলের মরাঘাট পরগণার গাদং তালুকে আসা কামরুপী ব্রাহ্মনদের বসতিস্থানকে স্থানীয় রাজবংশীরা নাম দিয়েছেন বামনের বাসা। ধূপগুড়ির গাদংয়ের বামনে বাসার বর্তমান ব্রাহ্মণ পরিবারের বরেন চক্রবর্তী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, হরেন চক্রবর্তী বা বাবুনাথ চক্রবর্তীদের পূর্ব পুরুষরা আদতে তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের কামরুপের বাসিন্দা।
গাদংয়ের বামনে বাসায় প্রথম আসেন অরবিন্দ দেবশর্মা, তিনি কিছুদিন থাকার পর ফিরে যান আসামের নলবাড়ির পৈতৃক বাড়িতে। পরে তার নাতি দেবেন্দ্রনাথ দেবশর্মা এসে বসতি গড়ে তোলেন। তৎকালীন কোচ রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ তাঁদের জমিও দেন। তাঁর হাত ধরে আরও দুই পুরোহিত মহেশ দেবশর্মা ও গোলক দেবশর্মা আসেন বামনে বাসায়। স্বতন্ত্র কোচবিহার রাজ্যের অবলুপ্তির সাথে কামরুপী এই ব্রাহ্মণদের পদবীতেও পরিবর্তন ঘটেছে। ছিলেন দেবশর্মা, হয়েছেন চক্রবর্তী অথবা ভট্টাচার্য। তবে পূজার্চনার রীতিতে পরিবর্তন ঘটেনি।ব্রাহ্মণদের মধ্যেও বেদ অনুসারে পূজার্চনার রীতি ভিন্ন। কামরুপী ব্রাহ্মণরা যজুর্বেদ অনুসারে পূজার্চনা করেন। যজুর্বেদ অনুসারে রাজবংশীদেরও বিবাহ, অন্নপ্রাশন থেকে অন্যান্য পূজার্চনা হয়ে থাকে। তাছাড়া কামরুপ, জল্পেশ, ভ্রামরী দেবীর পীঠকে কেন্দ্র করে কামতাপুর ও পরবর্তীকালের কোচবিহার রাজ্যের ধর্মীয় রীতিনীতি গড়ে উঠেছে। শিব ও চন্ডী এখানকার আরাধ্য দেবদেবী। বর্তমান উত্তরবঙ্গ ও অসমের এই পীঠস্থানগুলিতে মূলত তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের কামরুপী ব্রাহ্মনরাই ছিলেন পূজারীর দায়িত্বে। কামরুপী এই ব্রাহ্মণদেরও আরাধ্য দেবী চন্ডি।
স্বতন্ত্র রাজ্য কোচবিহারের অবলুপ্তি ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের জেলা রুপে চিহ্নিত হয়েছে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি। কামরুপী ব্রাহ্মণরা ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছেন। বাঙালি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অনেকের আত্মীয়তাও গড়ে উঠেছে। তবে এখনও কামরুপ কেন্দ্রীক পূজার রীতিনীতিতে বদল ঘটেনি তাদের। স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকদেবী ভান্ডানি দেবীর পূজাই হোক কিংবা কারও বাড়িতে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ অথবা দূর্গা পূজা এখনও মন্ত্রোচ্চারণের সময় চক্রবর্তী বা ভট্টাচার্য নয়, নামের সঙ্গে উল্লেখ করেন পূর্ব পুরুষদের পুরণো পদবী দেবশর্মা। এ প্রসঙ্গে বরেন চক্রবর্তী বলেন, আমাদের বংশের পূর্বসূরীদের পদবী ছিল দেবশর্মা। বাবুনাথ চক্রবর্তী বলেন, মন্ত্রোচ্চারণের সময় আমরা দেবশর্মা পদবী ব্যবহার করি এবং রাজবংশীদের দেব বর্মন পদবী ব্যবহার করা হয়।
ধূপগুড়ির গাদংয়ের বরেন চক্রবর্তীর বাবা প্রয়াত দেবেন্দ্রনাথ দেবশর্মা খোকা ঠাকুর নামে পরিচিত ছিলেন।তাঁর পিতামহ অরবিন্দ দেবশর্মা প্রথম গাদংয়ে আসেন। সে সময় গভীর জঙ্গলে আবৃত ছিল গাদং, তিনি এখান থেকে ফিরে যান। পরে তাঁর পিতা মহিম দেবশর্মার হাত ধরে ষ গাদংয়ে এসে বসত নির্মাণ করেন দেবেন্দ্রনাথ দেবশর্মা। ওই সময় গাদং ছিল কোচবিহার রাজ্যের বাইশচালা ছিটের অন্তর্গত। তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের রাজা তাদের বসতি স্থাপনের জন্য জমি দিয়েছেন। বরেন চক্রবর্তী বলেন, রাজার দেওয়া জমির পাট্টা এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। আমার দাদা মানিক চক্রবর্তী ধূপগুড়ি শহরে থাকেন, দাদার কাছে সেই পাট্টা রয়েছে। প্রদীপ ভট্টাচার্যের বাবা প্রয়াত তপন ভট্টাচার্য গাদংয়ে যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বরেন চক্রবর্তী বলেন, আমরা এখানকার ভূমিপুত্র, আমাদের পূর্ব পুরুষ তৎকালীন কামতাপুর বা কোচবিহার রাজ্যের বাসিন্দা। তবে আমাদের সমস্ত কিছুই এখন বাংলাকেন্দ্রীক।