পালিত হলো রাজবংশী সমাজের বিষুয়া উৎসব
ক্ষীরোদা রায়, ডুয়ার্স: রাজবংশী সমাজের চৈত সারান্তি ও ভাজাভুজা বাংলা বছরের শেষ দিনে রাজবংশী সমাজের বিশেষ পার্বন বিষুয়া উৎসব পালিত হলো । ধূপগুড়ি, ফালাকাটা সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও আসামে পালন করা হয় বিষুয়া বা বিষুমা উৎসব। তবে বিষুমা বা বিষুয়া উৎসব ঘিরে প্রাচীন রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। সাধারণত মাসের শেষ দিনটিকে বলে সংক্রান্তি। রাজবংশী ভাষায় সংক্রান্তি শব্দটি সারান্তি বা দোমাসী অর্থে ব্যবহৃত হয়। বছরের শেষ দিনটিকে বলে চৈত্র সংক্রান্তি। রাজবংশী সমাজে এই সংক্রান্তি চৈত সারান্তি বা বিষুমা উৎসব নামে পরিচিত। ধূপগুড়ির প্রবীণ ব্যক্তি সন্তোষ রায় বলেন, এইদিন রাজবংশী সমাজে অনুষ্ঠিত হয় ভাজাভুজা পর্ব। ভাজাভুজা শব্দের অর্থ ভাজা জাতীয় খাবার। এই সারান্তিতে কড়াইতে ভেজে নেওয়া খাবার প্রথমে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয়। তারপর সেই ভাজাভুজা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে এই উৎসব বা অনুষ্ঠান এখানেই শেষ হয় না। আরও আছে এর অন্য কয়েকটি অঙ্গ। এইদিন প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোরও দিন। ভাজাভুজা খাবার মূলত প্রকৃতি থেকে প্রদত্ত খাবারের কথা বলা হয় না। নতুন বছরের শুরুতে অন্তিম বছরের শেষ দিনটিতে প্রকৃতিকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে রাজবংশীরা। গবেষকদের মতে, এইদিন সকাল বেলা রাজবংশী মানুষেরা পাণিমুতারী, বিস্তি, বেত, গাঁজা ইত্যাদি গাছ বা গাছের ডাল যোগাড় করেন। এইসব গাছ সহ পিয়াঁজ, রসুন ঘড়ের দরজা ও ঠাকুর ঘরে বেঁধে দেন। তবে, এইসব গাছের ডাল, পিয়াঁজ, রসুন বাঁধার সঙ্গে যোগ রয়েছে অন্য আর একটি কাহিনীর। সেই কাহিনীকে অনেকেই কল্প কাহিনী বলে দাবি করেন। ভগবান বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম ক্ষত্রিয় ধ্বংস করতে উদ্যত হন। কামরূপের ক্ষত্রিয়রা পরশুরামের ভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। আত্মগোপন কালে অনেক ক্ষত্রিয় আদিবাসী, ডোম, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষের ঘরে আশ্রয় নেন। এইসব ক্ষত্রিয়ই ভঙ্গ ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত। কথিত আছে, এইসব ক্ষত্রিয় নিম্ন বর্ণের মানুষের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করলে সেখানে তারা ঘরের মধ্যে পাণিমুতারী, বিস্তি সহ বিভিন্ন ধরনের কাঁটা জাতীয় গাছের ডাল ঘরে বেঁধে দেন। এমন ঘর কেবলমাত্র প্রাচীন আদিবাসী ও নিম্ন বর্ণের মানুষের বলে পরশুরাম সেই বাড়িতে থাকা মানুষের উপর আক্রমণ করেন নি। এই ভঙ্গ ক্ষত্রিয়রাই রাজবংশী। আবার, অন্য আর একটি যুক্তি হলো এইসব কাঁটা জাতীয় গাছের ডাল বাঁধা থাকলে দ্যাও, ভূত বা অপদেবতা ঐ বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। রাজবংশী কবিরাজ বা তান্ত্রিকেরা এই দিনটিকে তন্ত্র-মন্ত্রের কাজে ব্যবহার করেন। কালীপূজা এবং এই দিনটি চড়া দিন বলে যে কোনো তন্ত্র-মন্ত্রের প্রয়োগ করলে অভীষ্ট ফল পাওয়া যায়। এই দিন অনেকেই ঘরবন বা বাড়িবন করেন।এই দিন বাড়ি বন করার উদ্দেশ্য হলো যাতে কোনো তান্ত্রিক বাণ মারলেও তা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। রাজবংশী সমাজের এই ভাজাভুজা অনুষ্ঠানে গাছের নতুন ফল অর্থাৎ কচি আম, লিচু, নতুন উৎপাদিত রসুন, পিয়াঁজ, আদা কুচি কুচি করে কেটে রাখা হয়। চিড়ে ভাজার সঙ্গে ছোলা, মটর ভেজে তাতে কেটে রাখা রসুন, পিয়াঁজ, আদা, নতুন ফল মিশিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয়। এর সঙ্গে দেওয়া হয় শুকাতি। পাটশাক শুকিয়ে গেলে তার যে রূপ তাই শুকাতি। এইদিন শুকাতিও দেওয়া হয় প্রসাদ হিসেবে। এই সব ভাজা জিনিসই ভাজাভুজা। এইদিন শুকাতির সাহায্যে অনেক বাড়িতে তৈরি করা হয় কাঞ্জির জল। যে পরিবারের কোনো সদস্য বাজ পড়ে কোনো সময় আহত হলে ব্যবহার করা হয় কাঞ্জির জল। কাঞ্জির জল সারা বছর রাখা হয়। একমাত্র সেই বাড়িতেই কাঞ্জির জল থাকে যে বাড়িতে বাজ পড়ে কেউ আহত হয়েছেন। এই কাঞ্জির জল থাকলে আর ঐ বাড়িতে দ্বিতীয় বার বাজ পড়বে না বা ঐ পরিবারের কেউ আহত হবে না বলে বিশ্বাস করেন রাজবংশী সমাজের মানুষ। আবার, কুকুর, বিড়াল কামড়ালে বা আঁচড়ালে এই জল খেলে জলাতঙ্ক রোগের কোনো ভয় থাকে না বলে বিশ্বাস করেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ। রমেশ রায় নামের এক যুবক বলেন, তবে এখন এই বিশ্বাস অনেকটাই উঠে গিয়েছে। রাজবংশী সমাজের এই ভাজাভুজার দিনে গাছের চারা লাগানো হয়। যা দূষণমুক্ত প্রকৃতি তৈরি করতে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এইদিন গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া হয় এবং বৃক্ষরোপণ করা হয়। প্রাচীন সামাজিক ব্যবস্থা অনুসারে এইদিন রাজবংশী সমাজের মানুষ শীকার করতে বের হতেন। তবে এখন আর কেউ শীকার করতে যান না। একদিকে যেমন প্রকৃতির পুজা করা হয় তেমনি ঈশ্বরকে অর্পণ করার মাধ্যমে প্রকৃতিপ্রদত্ত ফুল, ফল, বীজ রাজবংশী সমাজের মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার, মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীসহ এই নৈসর্গিক প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করার যে চিন্তা ভাবনা তা বাস্তব রূপ ধারণ করে ভাজাভুজা অনুষ্ঠানের দিন চৈত সারান্তিতে। কৃষিকাজের প্রতি রাজবংশী সমাজের মানুষ যে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন তা পাট, আদা, রসুন, পিয়াঁজ দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পণের মাধ্যমেই বোঝা যায়। রামমোহন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক জগদা রায় বলেন, “অমানুষিক প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মনুষ্যেতর প্রাণীসহ প্রকৃতির সংরক্ষণের বিষয়টি ভাজাভুজা অনুষ্ঠানের অনন্যতা।”