ফালাকাটায় নেই আইসিইউ, রেফার করা হয় শিলিগুড়ি, অর্ধেক পথেই গভীর রাতে মৃত্যু হলো ধনেশ্বর রায়ের
ক্ষীরোদা রায়, জটেশ্বর: উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া জগতের কিংবদন্তি প্রবাদপ্রতিম ভাওয়াইয়া শিল্পী তথা জনপ্রিয় ‘ও বৈদেশা বন্ধুরে’ ভাওয়াইয়া গানের স্রস্টা বঙ্গরত্ন ধনেশ্বর রায় প্রয়াত হয়েছেন। গত শুক্রবার সকালে অসুস্থ হলে তাঁর ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে সেখান থেকে রেফার করা হয় শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। গভীর রাতে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার পথে তিস্তা নদীর কাছে অ্যাম্বুলেন্সেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয় ৮৬ বছর। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতি মহলে। ভাওয়াইয়া সঙ্গীত জগতে একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো বলে মনে করেন উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিপ্রেমীরা।
উল্লেখ্য, বেশ কয়েকবছর ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। গত বুধবার অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে ফালাকাটার জটেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে বাড়িও আনা হয়। তবে শুক্রবার ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন ধনেশ্বর বাবু। সোয়াব টেস্টের পর তাঁর করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বাড়িতে খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। যার ফলে ৮৬ বছরের প্রবাদপ্রতিম ভাওয়াইয়া শিল্পী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার দুপুর নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্সে করে পরিবারের সদস্যরা ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কিংবদন্তি শিল্পীকে দেখতে ছুটে যান ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মন, ফালাকাটা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ রায়, জলপাইগুড়ির সাংসদ ডাঃ জয়ন্ত রায়, রাজবংশী চলচ্চিত্র পরিচালক তপন রায়।
তবে বিশিষ্ট শিল্পীর চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে কিছুটা অভিযোগ উঠেছে। অসুস্থ ধনেশ্বর রায়কে আইসিইউতে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো না থাকায় তাঁকে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে আইসিইউয়ে জায়গা না থাকায় আলিপুরদুয়ার নিয়ে যাওয়া হয়নি প্রয়াত ধনেশ্বর রায়কে। পরে জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায় শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করেন। গভীর রাতে ধনেশ্বর রায়কে নিয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন পুত্র সুশীল রায়। প্রয়াত শিল্পীর পুত্র সুশীল রায় বলেন, রাত আড়াইটা নাগাদ বাবার মৃত্যু হয় তিস্তা সেতুর কাছে। ফালাকাটায় আইসিইউ না থাকায় প্রথমে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে জায়গা না থাকায় শিলিগুড়ি রেফার করা হয়। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা না যেতেই বাবার মৃত্যু হয়। ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মন বলেন, ‘ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চিকিৎসকরা ধনেশ্বর বাবুকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করেন। চিকিৎসকরা ওনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল, তাঁরাও চেষ্টা করেছিল তাঁকে বাঁচাতে। কিন্তু রাজ্য সরকার ফালাকাটায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি করলেও পরিকাঠামো তৈরি করেনি। শুধু ধনেশ্বর বাবুই নন সবার জন্য পরিকাঠামো দরকার।’ ফালাকাটা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি তথা সমাজসেবী সুভাষ রায় বলেন, ধনেশ্বর রায় সকলের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যু আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি। ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে পরিকাঠামো ঠিকই আছে, তবে আইসিইউ বা সিসিইউ না থাকায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। ফালাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তথা ধনেশ্বর রায়ের কাছের মানুষ বলে পরিচিত ক্ষিতীশ রায় বলেন, ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউ ইউনিট না থাকায় ধনেশ্বর রায়ের চিকিৎসায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধে আইসিইউ ও সিসিইউ ইউনিট চালু করা খুব প্রয়োজন। অপরদিকে মহাসড়কের কাজ চলছে ফালাকাটা থেকে গুয়াবরনগর ও জলঢাকা থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত। রাস্তার কাজের জন্য গর্তে ভরা রাস্তায় মরনাপন্ন রোগীর জীবনের বহু সময় নষ্ট হয়। দাবি উঠেছে বর্ষার আগে রাস্তার সংস্কার করার।
উল্লেখ্য, ‘বৈদেশা বন্ধুরে, একবার উত্তরবাংলা আসিয়া যান, হামার জাগাখান দেখিয়া যান’ গান রচনায় রাজ্য সরকার তাঁকে বঙ্গরত্ন সম্মানে সম্মানিত করেন। আজি গাড়িয়াল বন্ধু মোর হারেয়া গেইসে রে, বন্ধু বড়ো ধন, ও কি ও মোর গাড়িয়াল ফিরিয়ারে আইসো ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ধনেশ্বর রায়। এদিন প্রয়াত শিল্পীর জটেশ্বরের আলিনগরের বাড়িতে তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী, অনুরাগী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। তবে করোনার কারণে অনেকে উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় শিল্পীকে শেষ দেখা দেখতে আসতে পারেননি।