রাজবংশী সমাজের ডাকলক্ষ্মী পূজা

Uploaded by : Kshiroda Roy

ছোট ন্যাঙলের বড় ঈষ
হামার ধানের ঝলঝলা শিষ।

সগারে ধান আউল ঝাউল
হামার ধান সকসকা চাউল।

আশ্বিনের সংক্রান্তিতে বা দোমাসির দিনে রাজবংশী, নাথযোগী, খেন সমাজের কৃষি ফসল ও ধন সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আঈ লক্ষ্মী বা খেতি লক্ষ্মী বা ডাক লক্ষ্মীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর চেয়ে ডাক লক্ষ্মী পূজার তিথি, পদ্ধতি ও লোকাচার ভিন্ন।

উত্তরবঙ্গ, আসাম, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ বিস্তির্ণ অঞ্চলে থাকা রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ডাক লক্ষ্মী পুজোর সূচনা হয় জোতদারদের মাধ্যমে। কোন মূর্তি গড়ে ডাকলক্ষী পূজা অনুষ্ঠিত হয় না। মূলত ধানের গাছকে কেন্দ্র করে আঈ লক্ষ্মী, খেতি লক্ষ্মী বা ডাক লক্ষ্মী পূজার সূচনা হয়। খেতের ফসলকে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের থাবা থেকে রক্ষা করতে রাজবংশীরা লক্ষ্মীদেবীর পূজা করেন।

আষাঢ় মাসে ধান রোপণের সময় গছিবুনা বা গুছি বোনার মধ্য দিয়ে গুছি লক্ষ্মীর আবাহন করা হয়। শুরু হয় ধান রোপণ। এরপর ধান গাছ বড় হয়। আশ্বিন মাসে ধানের শিষ দেখা যায়। ধান গাছের শিষ আসাকে গাও ভারি বা গর্ভধারন বলা হয়। এই সময় পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের আক্রমণে যাতে ফসল নষ্ট না হয় সে জন্য দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য আশ্বিন মাসের শেষ দিনটিতে কিংবা কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে খেতি লক্ষ্মী বা ডাক লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।

দুইটি ভিন্ন পর্যায়ে ডাকলক্ষ্মীর পূজো সম্পন্ন হয়। বাড়ীর বাইরে ধানক্ষেতের পার্শ্ববর্তী কোন পরিস্কার স্থানে অথবা ‘টাড়ি’র বা পাড়ার কোন বাড়ির খলতো বা আঙিনাতে পাটকাঠি দিয়ে একটি মণ্ডপ বা ঠাকুরমারি তৈরী করা হয় এবং লক্ষ্মীদেবীর প্রতীক হিসাবে সেখানে রাখা হয় অনেকগুলি ধানের গোছা। টাড়ির প্রতিটি বাড়ির লোকেরাই শুদ্ধাচারে ধানক্ষেত থেকে শিকড় ও মাটিসমেত ধানগাছের গোছা নিয়ে এসে ঠাকুরমারিতে লক্ষ্মীদেবীর আসনে স্থাপন করেন। ধানগাছের এই গোছাকে ‘গয়’ বলা হয়। যেহেতু এই পূজায় কোন মূর্তি থাকে না,তাই ‘গয়’কেই দেবী রূপে কল্পনা করা হয়। মহিলাদের পরিবর্তে বাড়ির প্রবীণ বা বিবাহিত পুরুষরাই প্রধানতঃ পুরোহিতের ভূমিকা পালন করে থাকেন। কলার পাতায় বা কলাগাছের খোলা কেটে তৈরী করা ডোঙ্গায় ফল, চাল-কলা, দুধ ও নানা মিষ্টান্ন ডাকলক্ষ্মীকে পুষ্পার্ঘ্য সহ নিবেদন করা হয়। পূজোর অঙ্গ হিসাবে অনেকে দেবীকে একটি হাঁস উৎসর্গ করে পায়ে দড়ি বেঁধে ধানক্ষেতে রেখে আসেন। মণ্ডপে পূজা শুরুর অনেক আগেই কৃষক পরিবারের পুরুষ,নারী ও শিশুরা সকলে মিলে কতগুলি মশাল ও প্রদীপ বা ‘ভোগা’ বানিয়ে রাখেন। পাটকাঠির মাথায় ঘি বা তেল মাখা পাটের আঁশ বেঁধে মশালগুলো বানানো হয়। এছাড়া কলার খোলা কেটে ডোঙ্গা বানিয়ে তার মধ‍্যে তেল ও সলতে দিয়ে প্রদীপ বা ‘ভোগা’ বানানো হয়। আবার অনেকে পাঁচখোলা ফলের (এই ফলের চালতার মত পাঁচটি খোলস থাকে বলে এর গ্রাম্য নাম পাঁচখোলা) খোলসে তেল ও সলিতা দিয়ে ‘ভোগা’ বা প্রদীপ বানান। মাটির বড় প্রদীপও আজকাল অনেকে ব‍্যবহার করেন। ‘ভোগা’ ঠিক মত উঁচু করে বসানোর জন‍্য কাঁচা বাঁশের মাথা চারভাগে চিরে তাতে গোঁজ ঢুকিয়ে চেরা অংশগুলোকে অনেকটা ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি গোলাকার বাঁশের কাঠির আঙটা বেঁধে দীপাধার বানানো হয়। এছাড়া মহিলারা জাম্বুরা (বাতাবি লেবু)র পাতা ও বেলপাতা শুকিয়ে বা কড়াইয়ে গরম করে নিম খইল বা সরিষার খইলের সাথে মিশিয়ে ছামগাইনে (বড় উদুখলে) গুঁড়ো করে এক ধরণের উগ্র গন্ধযুক্ত ভেষজ গুঁড়ো বা দল বানিয়ে রাখেন। সন্ধ‍্যা বেলায় ঠাকুরমারিতে ‘ভোগা’ জ্বালিয়ে কিছু পরিমাণ ভেষজ গুঁড়ো সেখানে ছড়ানো হয়। এরপরে প্রতিটি রাজবংশী কৃষক পরিবারের পুরুষ, নারী ও শিশুরা সকলে মিলে ‘ভোগা’, মশাল, বাঁশের তৈরী দীপাধার ও ভেষজ গুঁড়ো প্রভৃতি নিয়ে যার যে ধানজমি থেকে ধানের গোছা আনা হয়েছিল তার সেই ধানের জমিতে গিয়ে প্রথমে জমিটিকে প্রদক্ষিণ করেন। প্রদক্ষিণের সময় সকলের হাতে থাকে একটি প্রস্ফুটিত শরদণ্ড (খাগ বা নলখাগড়া) অথবা একটি পাটকাঠি। জমির চার দিকে পরিক্রমার শেষে জমির ঈশান কোণে শরদণ্ড বা পাটকাঠিগুলি পুঁতে দেওয়া হয়।তারপরে যে হাঁসের পায়ে দড়ি বেঁধে ধান ক্ষেতে রাখা হয়েছিল,সেই হাঁসটিকে ধানজমির চারদিকে প্রদক্ষিণ করিয়ে ধান ক্ষেতেই বলি দেওয়া হয় এবং বেশি ফসলের আকাঙ্খায় হাঁসের মাথাটিকে ধানক্ষেতেই পুঁতে দেওয়া হয়। এই রীতিকে ‘হাঁস ধেধেরা’ বলে। পরে এই হাঁসের মাংস রান্না করেই যখন সকলকে খাওয়ানো হয়,তখন তাকে ‘ভেণ্ডেরা’ বলে। ধানজমির চারদিকে প্রদক্ষিণ শেষে জমির আইলের ধারে একটি পরিস্কার স্থানে সাথে নিয়ে আসা দুই বা ততোধিক বাঁশের দীপাধার পুঁতে তার মাথার উপরে পাঁচখোলা ফলের ‘ভোগা’ বা কলাগাছের খোল দিয়ে বানানো ‘ভোগা রেখে তাতে তেল ও সলিতা দিয়ে প্রদীপের মত জালিয়ে দেওয়া হয় ও পাটকাঠির মশালগুলো জমির আইলে পুঁতে আগুন জ্বালানো হয় । একে বলে ‘গোছা দেওয়া’।এরপরে বাড়ির প্রধান পুরুষ জমিতে দলের গুঁড়ো ছিটাতে ছিটাতে চিৎকার করে কিছু আঞ্চলিক ছড়া বলতে থাকেন, আর পরিবারের বাকি সকল পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা তার সাথে সাথে সেই ছড়াগুলো চিৎকার করে বলতে থাকেন। চিৎকার করে ডেকে ডেকে সবাইকে নিজের ধান জমিতে লক্ষ্মীর অস্তিত্ব জানান দেওয়া হয় বলেই এই পূজার নাম ‘ডাক লক্ষ্মী পূজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *