কোচবিহার রাজ্য ও মোরাঘাট পরগণার গাদংয়ের ইতিহাস : দ্বিতীয় কিস্তি
ব্রিটিশরা কোচবিহারে আসার পূর্বে সমগ্র উত্তরবঙ্গ, বিহারের কিয়দংশ, বর্তমান বাংলাদেশের রঙপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী বা আসাম থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কোচবিহার রাজ্য। সপ্তদশ শতকে ভূটান রাজ কোচবিহার আক্রমণ করেন, ডুয়ার্সের ব্যাপক অংশ দখল করেন। ভূটানের সঙ্গে কোচবিহারের সীমান্ত সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাতের ফলস্রুতিতে তৈরি হয়েছে বাইশচালা ছিট। বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং এলাকায় থাকা সেই বাইশচালা ছিটের গাদংয়ের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরলেন হামার চ্যানেলের নিউজ এডিটর ক্ষীরোদা রায়।
বর্তমান গাদংঃ ব্রিটিশ পূর্ববতী মরাঘাটের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট সংখ্যক তথ্য প্রমাণের অভাব হেতু তৎকালীন ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরা অনেকটাই কঠিন। বলা যেতে পারে, ভূটানের দেবরাজাদের আক্রমণ পূর্বে মোরাঘাট পরগণা কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত একটি শান্ত এলাকা ছিল। নদী ও ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল সমগ্র এলাকা। নদীগুলির গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ডুডুয়া নদী উত্তর পূর্বে সড়ে গিয়েছে, তেমনি গিলান্ডি নদীও গতিপথ পরিবর্তন করেছে বলে বর্তমান সময়ের মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং এলাকার বিস্তৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান মোরাঘাট তাঁর অস্তিত্ব বজায় রেখেছে বর্তমান বনদপ্তরের একটি রেঞ্জ হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে মোরাঘাট পরগণার মাগুরমারি, গোঁসাইরহাট ও গাদং তালুকে জনবসতি ছিল কম এবং সম্পূর্ণ এলাকা জঙ্গলে ঘেরা ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা মূলত কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ করত। ধান চাষ ছিল মূল পেশা। বর্ষায় পায়জাম, কলম ইত্যাদির মত ধান চাষ করত। বৈশাখ বা জৈষ্ঠ মাসে চায়না ধান, বিতিরি ধান বা ভাদোই ধান চাষ করত। এছাড়াও পাট, তামাক, কাঁচা লঙ্কা চাষ করত।
জমিদারি ব্যবস্থা ছিল এই তিনটি তালুকে। গাদং তালুক নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
গাদং তালুক বর্তমানে গাদং ১ ও ২ নং অঞ্চলের ওপর অবস্থিত। ধূপগুড়ি ব্লকের কৃষি অধ্যুষিত দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতে বিভক্ত এই তালুক। তবে ব্রিটিশ শাসনকালে গাদংয়ের যে পরিসীমা ছিল বর্তমানে এর কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। গাদং ১ অঞ্চলে যেমন যুক্ত হয়েছে ভোটপাড়া, খলাইগাঁও (বর্তমানে খলাইগ্রাম) নামের দুটি গ্রাম যা একসময় ভূটানিদের দখলে ছিল। ভোটপাড়া শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ভোটদের পাড়া। ভূটানিদের ভোট বলা হতো। অন্যদিকে গাদং ২-য়ে যুক্ত হয়েছে পুন্ডিবাড়ির মত এলাকা।
গাদং নামের উৎপত্তিঃ গাদং নামের উৎপত্তি হয়েছে গাও ধং শব্দ থেকে। গাও অর্থ শরীর ও ধং হল ধোওয়া। গাদম্ নামের একটি নদী বয়ে গিয়েছে এই এলাকার উপর দিয়ে। সেই নদীর নাম থেকে এই এলাকার নাম হয়েছে গাদং। শোনা যায়, নদীতে স্নান করতে নামা স্থানীয় মানুষের কাছে ব্রিটিশরা জিজ্ঞেস করে এই এলাকার নাম , প্রত্যুত্তরে স্থানীয় মানুষ উত্তর দেয় গাও ধং। সেই থেকে গাদং নামের উৎপত্তি। গাদম্ নদীতে দীর্ঘদিন ধরে গাদম্ পুজো করা হয়। ভগবান শিবকে গাদম্ রুপে পূজা করা হয়। প্রকান্ড বট গাছের তলায় এক সময় পাথরকে শিব রুপে পূজা করা হয়। বট গাছের মূল কান্ডটি নদী ভাঙনে তলিয়ে যায়।
গাদংয়ের বিভিন্ন স্থানের নামকরণঃ ১২ বিঘায় অথবা ১৫ বিঘায় ছিল এক হালের জমি। এক দাগে জমি থাকতো। এগুলিকে জোত বলা হয়। জোতের মালিকদের জোতদার বলা হতো। এক একজন জোতদারের অধীন দশ হাল কিংবা তার বেশি জমি থাকতো। অর্থাৎ একশো বিঘার বেশি জমি থাকতো জোতদারের দখলে। জোতদারের নাম অনুসারে কোথাও জায়গার নাম তৈরি হয়েছে। যেমন বারহালিয়া নামের জায়গার নাম তৈরি হয়েছে বুধারু রায় (বুড়া) নামের জোতদারের ১২ হালের সম্পত্তি থেকে।
কাজিপাড়ার নাম হয়েছে ইব্রাহিম কাজির নাম অনুসারে। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি ছিলেন গাদং ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশরা বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন চালু করে। আইন অনুসারে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর ছিল। সর্বনিম্ন স্তর হল ইউনিয়ন কমিটি। পাঁচ থেকে নয়জন সদস্যকে নিয়ে ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হবে।
গাদংয়ের গাদং হুজুরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার নামরণ হয়েছে হুজুর সাহেবের নামে। তিনি ছিলেন জোতদার। তাঁর জমিতে মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।
পূর্ব ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের নামকরণ হয়েছে উঁচু জায়গা হিসেবে। এখানে ধাপের ডাঙ্গা বলে জঙ্গলে ভরা একটি উঁচু স্থান এখনও রয়েছে। এই গ্রামের উপর দিয়ে একসময় নদী বয়ে গিয়েছে বলে অনুমান। কারণ ঐ গ্রামে এখনও একটি গভীর জলাভূমি রয়েছে, যাকে কদম কুড়া বলা হয়। সাধারণত নদীর গতিপথে এই ধরনের গভীর পুকুর তৈরি হয়। ঐ গ্রামেই রয়েছে ভোটপাড়ার থান। সেখানে একসময় ভূটিয়ারা মাচা (চাঙাড়া) বেঁধে বাস করত। পাশেই ছিল কোঠাই জমিদারের কামাত। তাঁর আর একটি কামাত রয়েছে পশ্চিম শালবাড়ি গ্রামে হাত্তিভাঙা সেতুর পাশে। অতীতে হাতির পদপিষ্টে ভেঙে যায় ঐ সেতু। তার পশ্চিমে গ্যালান্ডি নদীর পাশে আছে বর্তমানের বাইশচালা এলাকা।
কোঠাই জমিদারের বাড়ি যে জায়গায় রয়েছে বর্তমানে সেই এলাকার নাম সাহেবটারি। একসময় ব্রিটিশ সাহেবরা এই এলাকায় আসতেন এবং বসতি স্থাপন করেন। শালবাড়িতে ছিল তৎকালীন থানা। শালবাড়ি থানার অন্তর্গত ছিল ফালাকাটা ও ধূপগুড়ি। সাহেবটারির অনতিদূরে ছিল সিপাইটারি। অন্তরাম রায় নামের সিপাই ছিলেন সেখানে। সিপাই হলো ব্রিটিশ পুলিশের চর। সিপাইটারির পূর্বে আছে কাছারি ঘাট। কর্ত্তানের কাছারি ছিল সিপাইটারির পশ্চিমে। ডুডুয়া নদীর ওপর রয়েছে এই ঘাট। নদীর ও পারেই ছিল লক্ষীপুর পরগণা। লক্ষীদুয়ার ছিল লক্ষীপুর পরগণার অধীন। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজ চলতো লক্ষীপুর পরগণায়। বর্তমানে সেখানে ছোট একটি চা বাগান ছাড়া লক্ষীপুর নামের এলাকার অস্তিত্ব নেই।
ক্রমশঃ চলবে……