গঙ্গার ছোবল ! আতঙ্কে ঘুম মাথায় উঠেছে বাসিন্দারদের
রতুয়া : মানিকচকের পর এবার রতুয়া-১ ব্লকের মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতে ছোবল মারল গঙ্গা৷ ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গিয়েছে আস্ত পুলিশ ক্যাম্প৷ প্রতিদিন অন্তত ৫০ বিঘা জমি গিলে নদী ছুটছে জনবসতির দিকে৷ আতঙ্কে ঘুম মাথায় উঠেছে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের৷ শুধু মহানন্দটোলাই নয়, গঙ্গার ভয়াবহ ভাঙনে বিপন্ন বিহারের কাটিহার জেলার কয়েকটি গ্রামও৷ এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারকেই দুষেছেন রতুয়ার বিধায়ক৷ তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অবিজেপি তিন রাজ্যকে মুছে ফেলতে চাইছে৷ গঙ্গা ভাঙনে বিপন্ন মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্রীকান্তটোলা, কান্তটোলা, জিতুটোলা, মনিরামটোলা, বুধারামটোলা, পটলডাঙা সহ কয়েকটি গ্রাম৷ সোমবার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গতকাল রাতে ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছে পুলিশ ক্যাম্পটিও৷ বুধারামটোলার বাসিন্দা কমল মণ্ডল জানালেন, ‘আমরা প্রায় ২০০ বছর ধরে এই এলাকার বাসিন্দা৷ কিন্তু গঙ্গা পাড় ভাঙতে ভাঙতে দ্রুতগতিতে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে৷ গতকাল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ নদীর ধারে ইটভাটার অফিসে থাকা পুলিশ ক্যাম্পটি নদীতে চলে গিয়েছে৷ তবে আগেই পুলিশকর্মীরা স্থানীয় ফ্লাড সেন্টারে চলে গিয়েছেন৷ কান্তটোলার মানুষ নিজেদের বাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন৷ ঘর থেকে জিনিসপত্র সরাচ্ছেন৷ সেচ দপ্তরের ইঞ্জিনিয়াররা আসছেন, জল মেপে চলে যাচ্ছেন৷ ভাঙন রোধের কাজ কিছু করেন না৷ এলাকার বিধায়কের ক্ষেত্রেও একই কথা৷ এই ভাঙনের জন্য অনেক জমিদার মানুষ আজ পরিযায়ী শ্রমিক৷ আমরা চাই, আমাদের বাঁচাতে গঙ্গাকে বাঁধা হোক৷’ ওই গ্রামেরই শৈলেশচন্দ্র মণ্ডল জানান, ‘বাতাস বেড়েছে৷ তাই ভাঙনও বেড়েছে৷ বেড়েছে নদীর জলের স্রোত৷ বাতাসে স্রোত পাড়ের নীচের অংশে ধাক্কা মারছে৷ সেখান থেকে মাটি বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তারপরেই উপরের ভারি অংশ ধসে যাচ্ছে৷ ক’দিন ধরেই বাতাস খুব বেশি৷ গতকাল রাতে নদীর ধারে থাকা পুলিশ ক্যাম্পটি গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে৷ যেটুকু ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে, আর দু’তিন ঘণ্টায় সেটাও নদীতে চলে যাবে৷ আমরা আতঙ্কে৷ প্রতিদিন দু’বেলা নদীর গতিবিধি দেখছি৷ বুঝতে পারছি না, কতদিন নিরাপদ রয়েছি৷’ শ্রীকান্তটোলার অলোককুমার মণ্ডল বলেন, ‘বছর আটেক আগেই গঙ্গা এখান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের নীচে ছিল৷ এই সাত বছরে নদী মহানন্দটোলা পঞ্চায়েত প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে৷ কয়েকদিনের মধ্যে মহানন্দটোলার সঙ্গে বিহারের দীনারামটোলাও মুছে যাবে৷ ভাঙন প্রতিরোধের দাবিতে আমরা চার বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি৷ কোনও লাভ হয়নি৷ আসলে গঙ্গা ভাঙন নিয়ে লড়াই করার মতো কোনও নেতা এই রাজ্যে নেই৷ তাই সুখে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি৷ দুই সরকার নিজেদের মধ্যে দড়ি টানাটানি করছে, আর মাঝখানে আমাদের মতো উলুখাগড়ার প্রাণ যাচ্ছে৷ কিছুদিন আগে বাংলা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের ইঞ্জিনিয়াররা একযোগে গঙ্গা ভাঙনের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন৷ কিন্তু এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ এটাই হয়৷ সব আই ওয়াশ৷ এভাবেই আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে৷’ এনিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা তথা রতুয়ার বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা তিন রাজ্য কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার৷ এখন উত্তর ভারতের বিপুর পরিমাণ জলরাশি গঙ্গা দিয়ে নীচে নেমে আসছে৷ এতে বিহারের মনিহারি ও আমদাবাদ, ঝাড়খণ্ডের মহারাজপুর, মালদার রতুয়া-১, মানিকচক, কালিয়াচক-২ ও ৩, মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান ও সামশেরগঞ্জ ব্লক গঙ্গার ভাঙনে বিপর্যস্ত৷ মনিহারিতে লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ধুলিয়ান পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গঙ্গার বাম তীরে তীব্র ভাঙন চলছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনার মতো গঙ্গার ভাঙন রোধেও কোনও টাকা রাজ্য সরকারকে দিচ্ছে না৷ আসলে ওরা চাইছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা, নীতিশ কুমারের বিহার, বাবুলাল মারাণ্ডির ঝাড়খণ্ডের মতো অবিজেপি রাজ্য মুছে যাক৷ কিন্তু ওরা জানে না, এই মুহূর্তে গঙ্গা আর ফুলহরের মধ্যবর্তী দূরত্ব মেরেকেটে মাত্র ২৫০ মিটার৷ কোনও কারণে সেই দূরত্ব মুছে গেলে দুই নদীর প্রবাহ পাগলা নদী দিয়ে গিয়ে পদ্মায় মিশবে৷ তখন ফরাক্কা ব্যারেজ অচল হয়ে যাবে৷ দেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে৷ নদীপাড়ের ১০ লক্ষ মানুষ রাস্তায় ঠাঁই নেবে৷ আমার জন্মস্থল মহানন্দটোলাও বাঁচবে না৷ তাই কেন্দ্রের কাছে আমাদের দাবি, গঙ্গার ভাঙন রোধের কাজের জন্য অবিলম্বে রাজ্যকে টাকা দেওয়া হোক৷ পাশাপাশি ভিটে হারা মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। আগামী দিনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমরা দিল্লি গিয়ে ১০০ দিনের কাজর বকেয়া টাকা,আবাস যোজনা টাকা, গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ এবং পুনর্বাসনের দাবি জানাবো।অন্তত ১০ লক্ষ মানুষের স্বার্থে৷’ রবিবার রাতে পুলিশ ক্যাম্প নদীতে তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন রতুয়া থানার আইসি সঞ্জয় দত্ত৷ তিনি বলেন, গঙ্গা নদীর ওপারে মহানন্দাটোলার মানুষের জমির রয়েছে। সেই জমিতে ফসল ফোলাতে গিয়ে তারা ঠিয়া পার্টিদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল।অই সমস্ত চাষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য গোদাই মহারাজপুরে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। এলাকার মানুষ যেন নিজেদের ফসল ঠিকঠাক ভাবে বাড়িতে তুলতে পারেন। কয়েকদিন ধরে গঙ্গা নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে। ‘আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, গঙ্গার ভাঙন থেকে ক্যাম্পটি বাঁচানো যাবে না৷ তাই ৩-৪ দিন আগেই ক্যাম্পের পুলিশকর্মীদের স্থানীয় ফ্লাড সেন্টারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল৷ তবে এখন ওই সমস্ত জমির চরগুলিতে জল উঠে যাওয়ায় সেখানে কোনও ফসল নেই৷ ফলে নিরাপত্তারও খুব একটা সমস্যা নেই৷’