প্রসঙ্গ: রাজবংশী ভিসি (উপাচার্য) ও রাজনীতি
বিশেষ সম্পাদকীয় প্রতিবেদন
“রাজবংশী ভিসি” নিয়ে সরগরম কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই প্রসঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা না বললেই নয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে রাজ্য সরকারের সাথে রাজ্যপাল এর সংঘাত আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগের জন্য সরকার (রাজ্য সরকার) যার নাম সুপারিশ করেন তাকেই নিয়োগ করেন রাজ্যপাল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করেছেন এ রাজ্যের রাজ্যপাল। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে মামলা হাইকোর্ট ছাড়িয়ে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সুপারিশ মেনেই উপাচার্য নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে রাজ্যপাল নিয়োজিত উপাচার্যরা রয়ে গেছেন সমস্যা তৈরী হয়েছে সেখানেই। রাজ্যের রুলিং পার্টি চাইছেন যেনতেন প্রকারেন রাজ্যপাল নিয়োজিত উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে তাদের পছন্দের উপাচার্য নিয়োগ করতে। কিন্তু যেখানে রাজ্যপাল নিয়োজিত উপাচার্য পদত্যাগ করতে রাজি নন বা রাজ্য সরকারের সাথে আপোষ করতে রাজি নন সেখানে শুরু হয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ির লড়াই। একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিখিলেশ রায়ও সরাসরি রাজ্যপাল নিয়োজিত একজন ভিসির । দীর্ঘদিন থেকে রাজবংশী ভাষা নিয়ে চর্চা করেন। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার সাথেও যুক্ত আছেন। বামফ্রন্ট আমল থেকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ব বিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের প্রতিবাদী চরিত্র রাজবংশী সমাজের কাছে তাকে আরও শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে দিয়েছে। এমন একজন মানুষকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করলে রাজবংশী সমাজের মানুষ যে প্রতিবাদ আন্দোলন করবেন এটাই স্বাভাবিক। রাজবংশী সমাজের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন ইতিমধ্যে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। এই বিষয় নিয়ে সোমবার একটি সংগঠনের ডেপুটেশন রয়েছে কোচবিহারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলতেই হয় যে রাজ্যপালকে নিয়োগ করে কেন্দ্র সরকার, বর্তমানে কেন্দ্র সরকার বিজেপি দ্বারা পরিচালিত। বিজেপি’র সুপারিশেই যে নিখিলেশ বাবুকে ভিসি করা হয়েছে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে রাজ্যের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিজেপি-তৃনমূলের লড়াই এখন রাজবংশীদের আত্মমর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিখিলেশ বাবুর অভিযোগ, “রাজবংশী ভিসি চাই না” বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার লাগানো হয়েছিল, রাজবংশীদের কটুক্তি করা হয়েছিল। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয় তাহলে তা হবে ভয়ংকর। তৃণমূল এর প্রতি আগামী দিনে ক্ষোভ বাড়বে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী মানুষের। হয়তো এমনটাই চেয়েছিল বিজেপি।
তাই যেখানে রাজ্য সরকারের সুপারিশ মেনে উপাচার্য নিয়োগ করার কথা সেখানে রাজ্যপালকে দিয়ে জোর করে পছন্দের ভিসি নিয়োগ করেছে বিজেপি’র উপর মহল। অথচ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র সরকারের হাতে অষ্টম তপশিলে রাজবংশী (ভিন্নমতে কামতাপুরি) ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও তা বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বিজেপির সমর্থক জিসিপিএ নেতা অনন্ত মহারাজ বা কেএলও চিফ জীবন সিংহ’র দাবি মেনে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এর বিষয়টিও দীর্ঘদিন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। রাজবংশী সমাজের বৃহৎ দাবি গুলি থেকে নজর ঘোরানোর জন্য এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের প্রতি রাজবংশী সমাজের ক্ষোভ কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় তারই একটি পরিকল্পনা কি কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ও রাজবংশী ভিসিকে ঘিরে এই বিতর্ক?
কোচবিহারে রাজবংশী সমাজের উন্নয়নের কান্ডারী মনিষী পঞ্চানন বর্মার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আন্দোলন, জমি দান, অর্থ দানের সময় রাজবংশী সমাজের মানুষই এগিয়ে এসেছিলেন তাই সেই মানুষেরাও চাইবেন রাজবংশী সমাজের একজন যোগ্য অধ্যাপক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিন। এতদিন এই সেন্টিমেন্ট বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল রাজ্য সরকারও। তাই ২০১৯ এর লোকসভা, ২০২১ এর বিধানসভার নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের বেশিরভাগ মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পরবর্তীতে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র সরকার ক্ষমতায় থাকার ১০ বছরেও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের জন্য তেমন কিছু না করায় বিজেপির প্রতি মোহভঙ্গ হওয়া শুরু করে। যার ফলস্বরূপ বিগত লোকসভা ভোটে কোচবিহার আসন বিজেপির হাতছাড়া হয়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল হওয়ার পরে কিছু তৃণমূল নেতৃত্ব যেভাবে রাজবংশী সমাজের বিশিষ্ট লেখক, সমাজসেবী বলে পরিচিত অধ্যাপক ড. নিখিলেশ রায় এর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তাতে করে আখেরে লাভ হবে বিজেপিরই। “রাজবংশী সম্প্রদায়ের” সেন্টিমেন্ট নিয়ে পালটা আরেকটি কেস করেছেন কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক তথা তৃণমূল নেতা সাবলু বর্মনও। যদিও এই কেসকে কেউ গুরুত্ব দিতে নারাজ। রাজবংশীদের সম্পর্কে কটুক্তি করার কথা অস্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল সমর্থিত কর্মচারী সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন এর নেতৃত্ব। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ায় রাজবংশী সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি নিখিলেশ রায় এর চরিত্রে কালি ছেটানোর জন্য যে উদ্যোগ শাসক পক্ষ নিয়েছে তা বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার নিখিলেশ রায়কে সরিয়ে দিলে রাজবংশী ভিসি নিয়োগ এর জন্য চাপ তৈরী হবে রাজ্য সরকারের ওপর। অরাজবংশী ভিসি হলে “রাজবংশী ভিসি চাই না” বলে যে পোস্টার লাগানোর বা রাজবংশী সম্প্রদায় সম্পর্কে কটু কথা বলার অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের শাসক পক্ষের বিরুদ্ধে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে রাজবংশী সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষও। ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।