পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, রাজবংশী মেয়েরাই পারে তাদের নিজস্ব মিডিয়াতে যুক্ত হয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে
পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাজবংশী মিডিয়াতে যুক্ত হয়ে রাজবংশী সমাজের মেয়েরাই পারে বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি হওয়া সামাজিক অসাম্য, বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা দূর করে সমগ্র সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এ বিষয়ে লিখেছেন ক্ষীরোদা রায়
জৈবিক বিভাজন ও এক বিস্তৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারীত্ব ও পৌরুষের বিভাজন রেখা টানা হয় লিঙ্গের ধারণায়। এই বিভাজন রেখা নারী ও পুরুষের ব্যবহারিক জগতের চলাচলের দিকে তাকালে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়। সাংবাদিকতা বা সংবাদমাধ্যমে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের অংশগ্রহণের হার থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে সংবাদমাধ্যমকে এখনও নারী উপযুক্ত স্থান মনে করেনি। বলা ভালো সামান্য একটা অংশ ছাড়া সেই অর্থে মহিলাদের অংশগ্রহণ সাংবাদিকতার পেশায় চোখে পড়ে না। সংবাদমাধ্যম হল নারী বা পুরুষের স্বাধীন কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। সুখ, দূঃখ, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা যায় সংবাদের মধ্য দিয়ে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শোষিত শ্রেণীকে সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবা হয়, অর্থাৎ পুরুষ হল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক এবং এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ও নারীর ওপর পুরুষ তার পৌরুষত্ব দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নারীর একান্ত নিজস্ব সবকিছুকেই। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষিত শ্রেণীর নাগরিকদের স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে কণ্ঠরোধ করার দিন ফুরিয়ে আসছে। নারীরা সচেতন হচ্ছে তাদের ব্যক্তি সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে। ফলতঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারছে তারা, যেমন- পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তে থাকা আটটি জেলার পশ্চাদপদ এলাকার মেয়েরা নিযুক্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। সংখ্যার দিক থেকে নগন্য হলেও তাদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব এখানেই যে পথের শুরুটা দেখাতে পেরেছে তারা এবং ধীরে ধীরে রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে তারা। গ্রাম থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে পুরুষদের সাথে সাথে মহিলা সাংবাদিকেরা তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনের আকারে পেশ করছে তারা। যেমন, কোচবিহারের পর্ণা কার্জি, শহর থেকে গ্রাম, রাজনীতি থেকে সামাজিক সমস্যা ঘটনাস্থল থেকে তুলে ধরছে। জলপাইগুড়ির শ্রাবস্তী রায় যেমন, রাজবংশী ভাষায় সাবলীল ভাবে খবর পাঠ করছেন এবং উত্তরবঙ্গের রক্ষণশীল রাজবংশী সমাজে নজির তৈরি করেছেন। তিনি চান রাজবংশী মেয়েরা রক্ষণশীলতা ভেঙে বেরিয়ে এসে বেশি করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হোক। হামার চ্যানেলের নিউজ অ্যাঙ্কর ববিতা রায় কলেজ পাঠরত, সাম্মানিক স্তরের ছাত্রীটি মনে করেন, সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে পারে মিডিয়া, মেয়েরা বেশি করে মিডিয়ার সাথে যুক্ত হলে তারা তাদের প্রতি হওয়া বৈষম্য, অন্যায়, শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবে।
বেট্টি ফ্রায়েডান যেমন ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর “ফেমিনিন মিস্টিক ” গ্রন্থে গণমাধ্যমের সমালোচনা করে অভিযোগ তুলে বলেছেন যে, মিডিয়া নারী সংক্রান্ত সংবাদ সেভাবে তুলে ধরে না, সেই একই প্রতিধ্বনি অধুনান্তিক নারীবাদী মিডিয়া তাত্বিকরা করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, বর্তমানে মিডিয়া নারীকে পরিবেশন করে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে, যেখানে নারীর যৌনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উদাহরণ দেখিয়ে তাঁরা বলেন, সামাজিক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বর্তমানে মিডিয়া নারীর যৌনতাকেই বেশি পরিবেশন করে, এমনকি কোন নারী ধর্ষিত হলে সেখানেও এক প্রকার নারীর যৌনতাকে প্রদর্শন করা হয়। তাঁদের মতে, পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া নারীর যৌনতাকে পণ্য হিসাবে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করতে চায়। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজন মিডিয়াতে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি ও নারীর মতামত প্রকাশের স্বাধীন মাধ্যম।
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজই শুধু রক্ষণশীল সমাজ নয়। উত্তরবঙ্গের সমগ্র সমাজে যৌনতাকে একান্ত ব্যক্তিগত গোপন বিষয় হিসেবে মানা হয়, যে কারণে রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সাথে অন্য জাতিগুলিও তারা তাদের নিজস্ব মিডিয়াতে যৌন উদ্দীপক কোন বিষয় প্রদর্শন করতে চান না। তবে রাজবংশী মিডিয়াগুলিতে সেই অর্থে পুঁজিবাদের থাবা না পড়ায় পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে রয়েছে রাজবংশী মিডিয়াগুলি। তবে রক্ষণশীলতার মোড়কে আবদ্ধ থেকে রাজবংশী সমাজের মেয়েদের সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকতে হয়।
একদিকে রক্ষণশীলতা এবং অপরদিকে চাহিদা নির্ভর সমাজব্যবস্থায় রাজবংশী মিডিয়াগুলি পিছিয়ে রয়েছে এবং যে কারণে রাজবংশী মিডিয়াগুলি নিয়ে সেই অর্থে পুঁজিবাদ ভাবে না। এজন্য রাজবংশী সমাজে নারী ও পুরুষের জৈবিক বিভাজন ভেঙে ফেলা দরকার। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এই সমাজে পুরুষের আধিপত্য খর্ব করতে মেয়েদের আরো বেশি এগিয়ে আসা উচিত মিডিয়াতে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যদি বিভাজন উসকে দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে হাতিয়ার করতে হবে পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকে। তবে যেহেতু রাজবংশী মিডিয়াতে পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণ নেই সেক্ষেত্রে এই সমাজের মেয়েরাই পারে সমাজ ব্যবস্থার বদল ঘটাতে। রাজবংশী মেয়েরা তাদের নিজস্ব মিডিয়াতে যুক্ত হয়ে সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিক এটাই চায় সমগ্র বিশ্ব সমাজ।