রৌদ্রতেজে ঘর্মাক্ত শরীর, অসুস্থ স্ত্রী, তারপরেও দলবদল করেননি চিন্তা মোহন, পড়ে আছেন সিপিএমেই
ক্ষীরোদা রায়, ধূপগুড়ি: রৌদ্রতেজে ঘর্মাক্ত শরীর, নিজের সামান্য আলু ক্ষেতে কাজ করতে ব্যস্ত একদা ধূপগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি চিন্তা মোহন রায়। ভাঙাচোরা বাড়িতে বাস, হৃদরোগে আক্রান্ত স্ত্রী, বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থায় সামান্য বেতনে কাজ করেন বাংলা বিষয়ে এম.এ. পাশ পুত্র। একমাত্র মেয়ে সংসারের জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সবই করেন। তার সমসাময়িক দলের অনেক নেতাকর্মী যখন দলবদল করে পদ পেয়ে গাড়ি, বাড়ি করেছেন, চিন্তা মোহন রায় সে পথে পা বাড়াননি। আদ্যোপান্ত সিপিআইএমের সঙ্গে থাকবেন এমন পণ রেখেই দলের দুর্দশার সময়েও ছাড়েননি দল। ধূপগুড়ি ব্লকের গাদং ১ অঞ্চলের পূর্ব ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা চিন্তা মোহন রায় শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের পাশে থাকবেন এই পণ করেই দলবদল করে জার্সি বদলাননি।গাদং ১ নং অঞ্চলের পঞ্চায়েত সদস্য হিসাবে প্রথম বার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন ১৯৯৮ সালে। ২০০৩ সালে ঐ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন। ২০০৮ সালে ধূপগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিঙ্গুর, নন্দিগ্রাম আন্দোলনের ঢেউয়ে তখন ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তৃণমূল কংগ্রেস বেশ কয়েকটি জেলায় ক্ষমতা দখল করে, উত্তরবঙ্গ বামেদের তখনও শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ধূপগুড়িতে তৃণমূল কংগ্রেস সিপিআইএমের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ২০১৬তে বামেদের হাতছাড়া হয় ধূপগুড়ি বিধানসভা। তারপর দলের বহু নেতাকর্মী এমনকি সিপিআইএম থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একে একে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করে। চিন্তা মোহন রায়ের কাছে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে প্রস্তাব যে আসেনি তাও নয়, কিন্তু তিনি নীতি, আদর্শে অবিচল থেকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন সিপিআইএমের হয়ে, দল পাল্টাননি তিনি।চিন্তা মোহন রায় বর্তমানে দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন না তাও নয়। স্ত্রী কল্পনা রায় হৃদরোগে আক্রান্ত, চিকিৎসা করাতে বহু জায়গায় গিয়েছেন, বর্তমানে শিলিগুড়িতে চিকিৎসা করাচ্ছেন। বাংলায় এম.এ. পাশ করে বি.এড. দিয়েছেন একমাত্র পুত্র জয়ন্ত রায়। স্কুল শিক্ষক হবার আশায় থাকতে থাকতে শেষমেশ সামান্য বেতনে বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থায় কাজে যোগ দিয়েছেন। এক কন্যা সন্তান বাড়ির সমস্ত কাজ করেন।চিন্তা বাবু নিজের সামান্য জমিতে চাষাবাদ করেন। রোজ সকালে সাইকেলে বস্তা ভর্তি ক্ষেতের ফসল বিক্রি করতে নিয়ে যান ধূপগুড়ি বাজারে। বাজার থেকে ফিরে নিজের জমিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি করেন। তবুও তার মধ্যে থেকে দলের সভা সমিতিতে যোগ দেন তিনি। তার দলের অনেকে যখন জার্সি বদল করে মোটা টাকার কারবার করছেন, চিন্তা বাবু আকড়ে আছেন গরিব মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ধূপগুড়ি বাজারে কাঁচামাল বিক্রি করা দেখে অনেকেই তার উদ্দেশ্যে উপহাস করে বলেন, “অনেকেই গাড়ি, বাড়ি করেছে; দাদা দল বদলালে তোমারও হতো।” তবে চিন্তা বাবু অনড় তার নির্দিষ্ট অবস্থানে। তার কথায়, কে কোন দিকে যায় যাক, ভালোমন্দ নির্ধারণ করবে মানুষ। মানুষের হাতেই সবকিছু, সাধারণ মানুষের ক্ষমতা আদায়ের জন্য আমরা লড়ছি, লড়ব। তিনি বলেন, “নীতি, নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে পারব না, যে দলে আছি সেখানেই থাকব। বাড়ির কাজের ফাঁকে যতটা সময় পারি দলকে দেওয়ার চেষ্টা করি।” চিন্তা বাবুর গ্রামের অনেকেই অবশ্য তার এই স্বভাবের প্রশংসা করেন। এমনকি বিরোধী দলের হয়েও ধূপগুড়ি ব্লক যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক মহাদেব রায় বলেন, চিন্তা দাদার আর্থিক সমস্যা বা বৌদির অসুস্থতা সত্ত্বেও নতুন দলে যোগ না দিয়েও যেভাবে পুরণো দলকে আকড়ে ধরে আছেন তা নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় অবশ্যই। গ্রামের বাসিন্দা দেবেন রায় বলেন, “বর্তমান সময়ে এমন মানুষ বিরল।”